নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকাঃ রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানার ফার্মগেট ইন্দিরা রোড এলাকার বাসিন্দা রাকিব হাসান (ছদ্মনাম)। পেশায় একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ভালোই আয় করেন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ অচেনা একটি নম্বর থেকে রাকিবের মোবাইল ফোনে একটি ক্ষুদেবার্তা আসে। বার্তায় লেখা ছিল, ঘরে বসে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট কাজ করে দিনে দুই থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় করার সুযোগ। এমন বার্তা পেয়ে রাকিব সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি। যোগাযোগ করেন ক্ষুদেবার্তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে।
তাকে প্রথমে কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলে লাইক ও সাবস্ক্রাইব করতে বলা হয়। তিনটি ইউটিউব চ্যানেলে লাইক ও সাবস্ক্রাইব করেন রাকিব। এর একটু পরই তার বিকাশ নম্বরে ৬০ টাকা চলে আসে। মাত্র তিনটি ক্লিক করেই টাকা আয়ের লোভে আরও কয়েকটি কাজ করেন রাকিব। এরপরই পণ্য কিনলেই আরও সহজে বেশি টাকা আয়ের সুযোগের প্রস্তাব দেওয়া হয়। আর এভাবেই নিজের অজান্তেই প্রতারক চক্রের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে তিন লাখেরও বেশি টাকা হারান রাকিব। পরবর্তীতে এই ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি। ঘটনার প্রায় দুই মাস পার হলে প্রতারক চক্রটি রয়েছে গেছে অধরা।
এদিকে শুধু রাকিব নন, ঘরে বসে সহজে আয় করা, আবেদন না করেও চাকরি পাওয়া, পরিচিত না হয়েও ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেকে। ফলে কিছু বোঝার আগেই হারাচ্ছেন টাকা। যদিও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বেশ কিছু প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে। তবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন চক্রের মূল হোতারা।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে,দিন দিন এ ধরনের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েই চলছে। মূলত বেশি লোভের কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতারক চক্রের দেখানো সহজে আয়ের লোভে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন শতশত মানুষ।
ভুক্তভোগী রাকিব (ছদ্মনাম) প্রতিবেদককে বলেন, হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ পেয়ে কৌতূহলবশত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কয়েকটা টাস্ক (কাজ) দেওয়া হয়। সেগুলো করলে কিছু টাকা দেয়। এভাবে বেশ কিছু টাস্ক (কাজ) করি। পরবর্তীতে আমাকে বড় টাস্ক দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ভিআইপি প্যাকেজের টাস্ক নামের সেই কাজে আমাকে ১৬টি পণ্য কিনতে বলা হয়। এরমধ্যে কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য ছিল। যেগুলো তাদের গছিয়ে দেওয়া। এই পণ্যের মূল্য বাবদ আমি বেশ কয়েকটি বিকাশ নম্বরে তিন লাখ ১৮ হাজার টাকা পাঠাই। এই টাকা পাঠানোর পরে তারা আমাকে জানায়, আমাকে আরও তিনটি পণ্য কিনতে হবে। এ জন্য এক লাখ টাকা পাঠাতে হবে। এই টাকা না পাঠালে আমার পাঠানো তিন লাখের বিপরীতে আমার লাভ করা ছয় লাখ ৯৬ হাজার টাকা তুলতে দেবে না। কিন্তু এরপরে দেখি সেই ওয়েবসাইটই বন্ধ হয়ে গেছে। তখন বুঝতে পারি যে, আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। পরবর্তীতে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। এই ঘটনায় জিডিসহ ডিবির সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ দিয়েছি কিন্তু তারা এখনো আসামি ধরতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, এই চক্রটি প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেও তাদের ফাঁদে পা দেওয়ার পরে যোগাযোগ করে টেলিগ্রামে। সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো তথ্য দেখার সুযোগ নেই। তারা যে ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সেটিও ১৫-২০ দিনের বেশি থাকে না। কয়েক ধাপে একেকজনকে ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তারা সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। গত কয়েক মাসে আমি দেখেছি ঘরে বসে টাকা আয়ের এই চক্রটি একজনের সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ দিনের বেশি কাজ করে না। প্রথমে তারা কিছু টাকা দিয়ে লোভ দেখালেও পরবর্তীতে ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিকাশ, নগদ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। এছাড়া বড় অঙ্কের টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক একাউন্টও ব্যবহার করে তারা।
ভুক্তভোগী রাকিবের কথার সূত্র ধরে একাধিক ব্যাংক একাউন্টের তথ্য পায় প্রতিবেদক। তারমধ্যে সিটি ব্যাংকের যশোর ব্রাঞ্চে খোলা একটি একাউন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোর ক্ষেত্রে বানোয়াট কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নামের ক্ষেত্রে এম আর ট্রেডার্স, যশোর সদরের হারানাধ দত্ত লেনের ঠিকানা দিলেও প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় রয়েছে গোঁজামিল। দোকান নম্বর দেওয়া হয়েছে শূন্য। যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা রবি নম্বরটিতেও কল যায় না। ঠিকানাসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ঠিক না থাকলেও লেনদেন ঠিকই চলছে। কয়েকটি মাত্র মোবাইল ফোন ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন নম্বর থেকে লাখ টাকা জমা হচ্ছে একাউন্টটিতে।
প্রতারক চক্রের অভিনব প্রতারণা ও সতর্কতা বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের সমাজে সহজে বেশি টাকা আয়ের পথ খোঁজা পথ কেউ ছাড়তে চায় না। শুধু আমাদের দেশে না, এটা সারা বিশ্বেই আছে। ফলে এই সহজে আয়ের লোভে পড়ে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে।
চক্রগুলো ঘরে বসে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদে ফেলে। তারা প্রথমে কিছু টাকা দিলেও যার পরিমাণটা শতকরা ১০ ভাগ। এভাবে বিশ্বাস অর্জন করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্লক করে দিয়ে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।
অনলাইনে ডুয়েল কারেন্সি নীতিমালা বাস্তবায়ন ও অন্তর্দেশীয় অপরাধী গ্রেফতারের তাগিদ দিয়ে এই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, মোবাইল ফোন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা দেশে আসা ও বিদেশে পাঠানো ক্ষেত্রে একটি আইন আছে। মোবাইল ফোন ব্যাংকিংয়ে রিচার্জ করা টাকা সঙ্গে সঙ্গে ডলার বা বিদেশি মুদ্রায় কনভার্ট করার অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়নি। পাশাপাশি অনলাইন প্রতারকদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশেও দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে। পাশাপাশি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেরও (বিএফআইইউ) কোনো সেল নেই যেখানে অভিযোগ দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, ঘটনা বিপুল পরিমাণ ঘটলেও খুব সামান্য পরিমাণ অভিযোগ থানা পুলিশের কাছে যায়। এই সব কিছুর সুযোগ নিচ্ছে প্রতারকরা। এছাড়া ১০ লাখের পুলিশ বাহিনীতে খুব সামান্য পরিমাণ জনবল রয়েছে সাইবার ক্রাইমে। যার সংখ্যা এক লাখও না। এর মধ্যে যারা আছে তাদের অধিকাংশ আবার সম্পূর্ণ দক্ষ না। এছাড়া আমাদের দেশে অন্তর্দেশীয় অপরাধীদের গ্রেফতারের নীতিমালা প্রয়োজন। কারণ এখন আমরা দেখছি পার্শ্ববর্তী দেশে বসে আমাদের দেশের মানুষকে টার্গেট করে প্রতারণা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে যে সকল মামলায় সাইবার অপরাধীরা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যাচ্ছেন। যার মূল কারণ ত্রুটিযুক্ত মামলা। তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতার ঘাটতি। ফলে আসামি গ্রেফতার হলেও আলামত সংরক্ষণ ও অভিযান স্থান নিয়ে ত্রুটি থাকায় সেই মামলার আরও কোনো ফলাফল নেই। জামিন নিয়ে অপরাধীরা বের হয়ে আবারও অপরাধ করছে। এখন পর্যন্ত ২০টারও কম মামলার রায় হয়েছে। অথচ মামলার সংখ্যা অসংখ্য।