জাহাঙ্গীর আলম
৮ মাস আগে দরপত্রের মাধ্যমে ১ কোটি ২১ লাখ টাকায় লোহার স্ক্র্যাপ বিক্রি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব স্ক্র্যাপের প্রকৃত মূল্য ছিল ৭ কোটি টাকা। বন্দরের এই অনিয়ম ধরা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে।
সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তার দুর্নীতির ফলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত ১৪ মে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দুদকের আকস্মিক অভিযানে এর সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম ১ এর উপপরিচালক নাজমুচসাদাত।
দুদক জানায়, গত ১৪ মে বন্দরের ভান্ডার শাখায় দুদক চট্টগ্রাম-১ এর সহকারি পরিচালক মো. এনামুল হকের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। অভিযান চলাকালে ভান্ডার শাখার ৩১, ৩২, ৫৮, ৫৯, ও ৬০ নম্বর লটে লোহার স্ক্র্যাপসহ অন্যান্য মালামাল বিক্রির কাগজ, স্টক রেজিস্ট্রার, মুভমেন্ট রেজিস্ট্রার এবং স্টক করা মালামাল সরেজমিন পরিদর্শন করে দুদক। পরিদর্শনে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন।
বন্দরের ভান্ডার শাখা সূত্রে জানা যায়-৩১, ৩২, ৫৮, ৫৯ ও ৬০ নম্বর পাঁচটি লটে স্ক্র্যাপ বিক্রি করা হয়। এরমধ্যে ৫৮, ৫৯ ও ৬০ নম্বর লটে স্ক্র্যাপের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ডাকা নিলামে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। ১৬ জানুয়ারি মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজকে দুই লটের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ৫৮ নম্বর লটে ৫০ টন বা ৫০ হাজার কেজি স্ক্র্যাপ দেখানো হয়। এ লটে রয়েছে-জাহাজ ও পন্টুনের পুরাতন প্রেইট, অ্যাঙ্গেল, গার্ডার ও অকেজো মালামাল। ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ টাকা দাম দেখানো হয়। একইভাবে ৬০ নম্বর লটে স্ক্র্যাপের পরিমাণ একই দেখানো হয়। মালামালও একই ধরনের। দাম দেখানো হয়েছে ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ টাকা। প্রকৃতপক্ষে এ দুই লটে স্ক্র্যাপের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৫০ টন।
কার্যাদেশ পাওয়ার পর মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক আল আমিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীর কাছে মালামাল বিক্রির চেষ্টা করেন। স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী আলমগীরকে তিনি ৫৮ ও ৬০ নম্বর লটের স্ক্র্যাপগুলো দেখান। তিনি জানান, ৫৮ নম্বর লটে ১৫০ টন ও ৬০ নম্বর লটে ৬০০ টনের কার্যাদেশ পাওয়া গেছে। প্রতি টন স্ক্র্যাপ ৬০ হাজার টাকা দরে আলমগীর কিনে নিতে চান। এজন্য আল আমিনকে কার্যাদেশ দেখাতে বলেন। তবে আল-আমিন দুই লটে মাত্র ১০০ টন স্ক্র্যাপের বৈধ কাগজ দেখাতে পারেন। তাই স্ক্র্যাপ নিতে আলমগীর অস্বীকার করেন। এরপর এ খবর বাইরে প্রকাশ পায়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী-চট্টগ্রামের সীমা স্টিল মিলের কাছে ৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় স্ক্র্যাপগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন আল-আমিন।
একইভাবে ১৬ জানুয়ারি মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্সকে ৩১, ৩২ ও ৫৯ নম্বর লটের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ৩১ নম্বর লটের মালামালের দাম ২ লাখ ২৭ হাজার ৯০০ টাকা ধরা হয়। ৩২ নম্বর লটের ৭ হাজার ১১৬ কেজি স্ক্র্যাপের দাম ৩৭ হাজার ৭০০ টাকা ধরা হয়। ৫৯ নম্বর লটের স্ক্র্যাপের পরিমাণ ৯৫ টন দেখানো হয়। অথচ এ লটে স্ক্র্যাপের পরিমাণ ৩৫০ টনের বেশি। ইব্রাহিম নিজেই স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী হওয়ায় অন্যের কাছে মালামাল বিক্রি করেননি।
দুদক জানান-৫৮, ৫৯ ও ৬০ নম্বর লটের স্ক্র্যাপের পরিমাণ ১ হাজার ১০০ টনের বেশি। অথচ মাত্র ১৯৫ টন দেখানো হয়েছে। কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও দুই প্রতিষ্ঠানের মালিক স্ক্র্যাপগুলো লুটপাট করেছে।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম ১ এর উপপরিচালক নাজমুচসাদাত গণমাধ্যমকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ভান্ডার শাখার ৭ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ মালামাল দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে মাত্র ১ কোটি ২১ লাখ টাকা বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করার একটি অভিযোগের ভিত্তিতে এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাইকালে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ এবং মালামালের ওজন পরিমাপ সাপেক্ষে বিস্তারিত প্রতিবেদন দুদক প্রধান কার্যালয়ের দাখিল করা হবে। প্রধান কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী আইননুগ প্রক্রিয়া গস্খহণ করা হবে।
এব্যপারে চট্টগ্রাম বন্দরের ভান্ডার শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কন্ট্রোলার অব স্টোরস প্রকৌশলী মো. আব্দুল হান্নান গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানে অনিহা প্রকাশ করে সচিবের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
দুদকের অভিযানের বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, দুদক অভিযান চালিয়েছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করছে। তদন্তে কেউ দোষী হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে মালামাল এখনো ডেলিভারি হয়নি, ডেলিভারি হওয়ার আগে অবশ্যই সব কাগজপত্র দেখে ওজন করেই ডেলিভারি হবে।