আবদুল মামুন,সীতাকুণ্ড-
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ব্যাঙের ছাতার মত যেখানে-সেখানে গড়ে উঠেছে অনিবন্ধিত আবাসিক হোটেল। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এখানে প্রায় দুই ডজন খানেক আবাসিক হোটেল চালু হয়েছে, যার কোনটারই নেই নিবন্ধন কিংবা লাইসেন্সও। এমনকি নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কোন কাগজপত্রও নেই আবাসিক হোটেলগুলোর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহেরও নেই কোন তদারকি ও নজরদারী। ফলে বাড়ছে অপরাধ, দুর্ঘটনা ও সামাজিক অবক্ষয়ের শংঙ্কা। কয়েক বছর আগেও সীতাকুণ্ড পৌরসদরে আবাসিক হোটেল ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। বছরের পর বছর কচ্ছপ গতিতে চলছিল হোটেলগুলো। কিন্তু ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারী সীতাকুণ্ড গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। সীতাকুণ্ডে বাড়তে থাকে পর্যটকের ভীড়। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠতে থাকে আবাসিক হোটেলও। বর্তমানে পুরো উপজেলা জুড়ে ২০ থেকে ২৫টি ছোট বড় অনিবন্ধিত আবাসিক হোটেল রয়েছে। কিন্তু যেনতেনভাবে গড়ে ওঠা এসব হোটেলগুলোতে নেই নিয়ম-নীতি শৃঙ্খলা এবং মানা হয় না হোটেল বিধিমালা। নিবন্ধন সনদ-বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ বিধিমালা আইন, ২০১৪ এর ধারা ২ এর উপধারা (৪), লাইসেন্স-বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন, ২০১৪ এর ধারা ২ এর উপধারা (১১) এবং সেবা-বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন, ২০১৪ এর ধারা ২ এর উপধারা (১২) অনুযায়ী প্রতিটি আবাসিক হোটেলকে জেলা প্রশাসন থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধন নেয়ার পর বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। আর এসবের জন্য হোটেল মালিক বা কর্মকর্তাকে সিভিল সার্জন এর কাছ থেকে স্বাস্থ্য সনদ, হোটেলের পরিবেশ ছাড়পত্র ও ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নিতে হবে। এছাড়া হোটেলের কর্মচারীদের অন্তত ১০ থেকে ২০ ভাগ সরকার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে, থাকতে হবে পার্কিং ব্যবস্থা। বাথরুমসহ প্রতিটি কক্ষ ১০৭ থেকে ১৯৩ বর্গফুট হতে হবে। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কর্মচারীদের ইউনিফর্ম ও নেমপ্লেট, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও প্রতিবন্ধীসহ সর্বজন প্রবেশগম্যতা থাকতে হবে। সেবামূল্য তালিকা ও লাইসেন্স সর্বসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। এছাড়াও প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও চিকিৎসক অন কলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিবন্ধন প্রাপ্তির পর হোটেল চালু করলে নিবন্ধন রেজিস্টার রাখতে হবে। যেখানে অতিথিদের নাম, আগমন-প্রস্থানের সময়, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা লিপিবদ্ধ থাকবে। একই সাথে অতিথির জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, সীতাকুণ্ডের কোন আবাসিক হোটেলেরই নেই কোন নিবন্ধন ও লাইসেন্স। নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। প্রায় প্রতিটি হোটেলের সরু গলি ও সিঁড়ি। ফায়ার লাইসেন্স নেই। এমনকি দু-একটি হোটেলে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকলেও বাকি হোটেলগুলোর নেই অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থা। এদিকে নিবন্ধন ও লাইসেন্স না থাকায় যেখানে-সেখানে মানহীনভাবে চলছে আবাসিক হোটেলগুলো। ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে হোটেল নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি পৌরসদরের বাইরে গ্রামের মধ্যে আবাসিক ঘর বাড়ীতে চলছে হোটেল ব্যবসা। আগত অতিথিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি কিংবা স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা রাখার বাধ্যবাধকতাও নেই হোটেলগুলোর। আইনত প্রতিদিন হোটেলে আগত অতিথিদের তথ্য সীতাকুণ্ড মডেল থানায় জমা দেয়ার কথা থাকলেও কোন হোটেলই তা দেয় না। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্কুল-কলেজের ছেলে মেয়েরা দলবদ্ধভাবে কক্ষ ভাড়া নিচ্ছে, আবার কয়েক ঘণ্টা পর চলেও যাচ্ছে। সুযোগের সদ্বব্যবহার করছে স্থানীয় ছেলেমেয়েরাও, পিছিয়ে নেই নানা অপরাধীরা। ফলে অপরাধ প্রবণতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। ২০১৮ সালের ১ই মে পৌরসদরে অবস্থিত সৌদিয়া আবাসিক হোটেলে বিষাক্ত মদপানে মৃত্যু হয়েছিল উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল হোসেন রবি ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নাছিরের। এরপর ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর জলসা আবাসিক হোটেলে এক যুবতী মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলো। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, প্রেমিক ও তার বন্ধুরা মিলে আবাসিক হোটেলে এনে টানা দু’দিন ধরে ধর্ষণ করেছে বলে ভুক্তভোগী তরুণী থানায় অভিযোগ করেন। অসুস্থ অবস্থায় সীতাকুণ্ড মডেল থানায় অভিযোগ করার পর পুলিশ প্রেমিক ও তার সহযোগী ৫ জন বন্ধু এবং হোটেল ম্যানেজারসহ ৬ জন ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে এবং ২০২২ সালে ২৬ অক্টোবর দুপুরে পাঁচ তলাবিশিষ্ট জলসা আবাসিক হোটেলে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সীতাকুণ্ড উপজেলা সমাজ কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি মোঃ গিয়াস উদ্দিন বলেন, আবাসিক হোটেলগুলোকে অবশ্যই নিয়ম-নীতি এবং নজরদারীর আওতায় আনতে হবে। মানসম্মত আবাসিক হোটেল না থাকায় অনেক পর্যটক চট্টগ্রাম শহরের হোটেল গুলোতে উঠে। আবাসিক হোটেলগুলোতে স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যাতায়তের এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব বন্ধে বাজার কমিটি, পুলিশ প্রশাসন ও হোটেল মালিকদের যৌথ উদ্যােগে কাজ করতে হবে। এখানে সামাজিক অবক্ষয় হয় এমন কিছু রোধ করা না গেলে অপার সম্ভাবনার এ পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। সরকারী ও পিপিপি’র (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশ) আওতায় এখানে মানসম্মত হোটেল-রিসোর্ট ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে দিন দিন আরো পর্যটক বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নূরুল আলম দুলাল বলেন, সীতাকুণ্ডের কোন হোটেলেরই ফায়ার লাইসেন্স নেই। এমনকি ফায়ার লাইসেন্স নেয়ার মত সেই অবস্থানও নেই আবাসিক হোটেলগুলোর। সবকটি হোটেলেরই গলি ও সিঁড়ি সংকীর্ণ এবং যেখানে দুইটি করে সিঁড়ি থাকার কথা সেখানে মাত্র একটি করে সিঁড়ি রয়েছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সীতাকুণ্ডের আবাসিক হোটেলগুলোর অবস্থা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
সীতাকুণ্ড পৌরসদর ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও গ্রীন ভিউ আবাসিক হোটেলের মালিক রেজাউল করিম বাহার বলেন, হোটেলে আগত অতিথিদের তথ্য ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা নেয়া এবং থানায় জমা দেয়ার কথা থাকলেও সবাই তা করে না। আবার পৌরসদরের বাহিরে গ্রামেও যত্রতত্র আবাসিক হোটেল গড়ে উঠছে। স্কুলের ছেলে মেয়েদের দল বেঁধে হোটেলে উঠার বিষয়ে এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা শুনেছি।
এবিষয়ে সীতাকুণ্ড আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি খায়রুল ইসলাম বলেন, দলবদ্ধভাবে আসা দু’একজন অতিথির জাতীয় পরিচয়পত্র আমরা নিয়ে থাকি, বাকিদের নেয়া সম্ভব হয় না। কারণ স্কুলের ছেলে মেয়েদের সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্র থাকে না।
সীতাকুণ্ড পৌরমেয়র বীরমুক্তিযুদ্ধা আলহাজ্ব বদিউল আলম বলেন, সীতাকুণ্ডে পর্যটক বেড়েছে সাথে পাল্লা দিয়ে অনেকগুলো আবাসিক হোটেলও গড়ে উড়েছে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসব গড়েতুলা হয়। নীয়ম-নীতি অনুসরণ করে আমরা পৌরসভার লাইসেন্স দিয়ে থাকি। আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, সীতাকুণ্ডের আবাসিক হোটেলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে এবং শৃঙ্খলায় ফেরাতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, পর্যটকের নাম ভাঙিয়ে অনৈতিক কোন কিছু করার সুযোগ নেই। সামাজিক অবক্ষয় হয় কিংবা স্কুলের ছেলে মেয়েরা হোটেল কক্ষ ভাড়া নেই এমন তথ্য পেলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।