সিআইডি (সিপিসি) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশের সাইবার স্পেসে সংঘটিত যেকোন অপরাধ উদঘাটনরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও আইনের আওতার আনার জন্য মনিটরিং সেল ২৪/৭ সাইবার পেট্রোলিং ও মনিটরিং করে থাকে। উক্ত সেল সিপিসির ফেসবুক পেইজ, হটলাইন নম্বর ও ইমেইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সাইবার সংক্রান্ত যে কোন অভিযোগ গ্রহণ করে থাকে।
পরবর্তীতে উক্ত অভিযোগসমূহ সিপিসি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করে। এই অভিযোগসমূহের সোর্স মূলত তিন (০৩) ধরনের সাইবার অপরাধে ব্যবহৃত ডিজিটাল ফরেনসিক, ম্যানুয়াল ব্যবহার ও অপরাধীদের প্রদত্ত জবানবন্দি।
এসকল কার্যক্রম করাকালীন সময়ে সিপিসি একটি প্রতারক চক্রের সন্ধান পায়। সিপিসি অনুসন্ধান করে জানতে পারে প্রতারক চক্রটি একটি বিশেষ এলাকার। যারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করে প্রতারণা করে থাকে। এই চক্রের সদস্যরা মানুষের সাথে প্রতারণা করে ২ টি ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে।
এ প্রতারকগণ দৈবচয়নের মাধ্যমে বা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত অথবা অর্থ সম্পদশালী ব্যক্তিদের দারোয়ান বা ড্রাইভারের সাথে সম্পর্ক করে পরিবারের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে সাথে পারিবারিক সমস্যা গুলো কৌশলে জেনে নিয়ে একই বাড়ীর মালিক ও স্ত্রীর নম্বর সংগ্রহ করে। তারপর শুরু করে প্রতারণার খেলা। স্ত্রীর কাছে স্বামীর বদনাম এবং স্বামীর কাছে স্ত্রীর বদনাম বলে কান ভারি করে। তখন উভয়ের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যেকে তাদের সমস্যা নিরসনের জন্য পথ খুজতে থাকে। এই সুযোগে উক্ত প্রতারকগণ মসজিদে নববীর ইমামের নাম প্রয়োগ করে প্রতারণা করতে থাকে।
দুপুরে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া সাংবাদিকদের জানান,গনমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চমকপ্রদ ও চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। লটারী পাইয়ে দেওয়া, ভাগ্য-বদল, পাওনা টাকা আদায়, মামলায় জেতানো, পারিবারিক সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয় তাদের বিজ্ঞাপনে। আধ্মাতিক ও তান্ত্রিক ক্ষমতা বলে বিপদগ্রস্থ মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যত বলে দিতে পারে। এরপর বিজ্ঞাপনে থাকা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে শুরু হয় পকেট কাটা।
এভাবেই চক্রটি পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেওয়ার কথা বলে এক নারী ভ‚ক্তভোগীর কাছ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ‘দরবেশ বাবা’ পরিচয়ে কয়েক ধাপে তার কাছ থেকে এই টাকা আত্নসাৎ করা হয়। দরবেশ বাবা পরিচয়দানকারী এই চক্রের ১৯ জন সদস্যকে মাগুরা জেলা ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে পৃথক অভিযানে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। খিলগাঁও থানায় দায়ের করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি।
তিনি আরো বলেন প্রতারণার শিকার নারী পারিবারিক সমস্যা থাকায় মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। এ অবস্থায় ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখে তার চোখ আটকে যায়। বিজ্ঞাপনে একজন সুদর্শন ব্যক্তি দরবেশ বেশধারী নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন।
বিজ্ঞাপনটি মন কাড়ে ঐ নারী চিকিৎসকের। পরবর্তীতে বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন তিনি। অপরপ্রান্তে থাকা দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি সুন্দরভাবে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। ভুক্তভোগী চিকিৎসক তার পরিবারের সমস্যার কথা তুলে ধরেন কথিত দরবেশ বাবার কাছে। সমস্যার কথা শুনে দরবেশ তাকে বলেন, ‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার উপর আস্থা রাখো।
তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। জানালে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং সমস্যা আরো বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’ নারী চিকিৎসক ভন্ড দরবেশের কথায় তার ভক্ত হয়ে যান।
এর পর থেকে বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন সময়ে অলৌকিক সমস্যার কথা বলে প্রলোভন ও ভয়-ভীতির মাধ্যমে মোট ২৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় এই প্রতারক চক্র। পরবর্তীতে এমএফএস নম্বরের সূত্র ধরে মাগুরা জেলা থেকে আশিকুর রহমান নামে একজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এটি একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রের বিভিন্ন টেকনিক্যাল সাপোর্ট, বেনামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম এবং ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়ার কাজ করে সে। পরবর্তীতে আশিকুরের দেওয়া তথ্যমতে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে কথিত দরবেশ পরিচয়দানকারী ১৮ জন আসামীকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
তিনি আরো জানান যে ২০২০-২১ সাল থেকে চক্রটি এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। প্রথম দিকে তারা বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতেন। পরবর্তীতে তারা পত্রিকা এবং বিভিন্ন চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তাদের দেয়া মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে সমস্যা সমাধানের নামে ভয়-ভীতি ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে এমএফএস নম্বরে টাকা হাতিয়ে নিতো চক্রটি।
আসামীদের নিকট থেকে প্রতারণার সাথে জড়িত ৪১ টি মোবাইল, বিপুল সংখ্যক সিমকার্ড ও ডিজিটাল আলামত উদ্ধার করা হয়।