চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছেন, জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিভিন্ন দপ্তর সংস্থার সাথে সমন্বয়ের সার্বিক বিষয়টি দেখার দায়িত্বে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। চট্টগ্রাম জেলার ১৫ উপজেলায় ১৬টি ও মহানগরের ১৬টিসহ মোট ৩২টি থানা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নাশকতা চলাকালীন মহানগরের বেশ কয়েকটি থানায় অগ্নিসংযোগসহ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করা হয়েছে।
এর বাইরে লোহাগাড়া থানায় ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বেশগুলো পুলিশ বক্সে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। থানাগুলোতে কি পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল, সেগুলোর কি হয়েছে, এ বিষয়গুলো বের করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়গুলো অত্যন্ত সিরিয়াস, বিষয়গুলো জানতে হবে। নিরাপত্তা রক্ষীদের যে সকল অস্ত্র-গোলাবারুদ চলে গেছে। আপনারা অনেকে জীবনের মায়া ত্যাগ করে সে অস্ত্রগুলো আপনারা অনেকগুলো অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করে জেলা প্রশাসনের ট্রেজারীতে দিয়ে গিয়েছেন।
লুণ্ঠিত অস্ত্র-গোলাবারুদ পাওয়া গেলে সেগুলো জেলা প্রশাসনের জুডিশিয়াল মুন্সিখানায় (জেএম শাখা) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিতে পারবেন। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হবে। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের প্রমাণ মিললে লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
চট্টগ্রাম জেলার যেখানে যেখানে অস্ত্র-গোলাবারুদ পাওয়া যাবে বলে দুষ্টিগোচর হয় দয়া করে সেগুলোর তথ্য দিলে আমরা আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অবহিত করবো ও তাদের মোবাইল নম্বর আপনাদেরকে দেয়া হবে, আপনারাও যোগাযোগ করতে পারবেন। উপজেলা পর্যায়েও এ ধরণের সভার আয়োজন করা হবে। এ জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়কদের সাথে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ সমন্বয় করবেন।
৮ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) বেলা ১২টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, যে সকল থানা ক্ষতিগ্রস্ত ও ধবংসস্তুুপে পরিণত হয়েছে সেগুলো একসাথে সক্রিয় করার জন্য এ মুহুর্তে জনবল নেই। ক্রাইম ও অন্যান্য যে কোন বিষয়ে থানায় অভিযোগ করতে গেলে সেখানে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ বাহিনীর মনোবল শক্ত করে তাদেরকে কর্মস্থলে ফেরানোর ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি।
আপনারা অনেক কাজ করেন, কিন্তু আপনাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, জেলা ও মহানগরীর থানাগুলোর পাশে যাদের বাসা-বাড়ি তারা স্বেচ্চাসেবক হয়ে দায়িত্ব নিলে আমরা তাদের সাথে বিএনসিসি, রোভার স্কাউটস্ ও গার্লস গাইড দিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে অন্ততঃ ১০জন করে তিন শিফটে থানার আশাপাশে ৮ ঘন্টা করে থাকে তাহলে পুলিশ তাদের নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করবে এবং কাজে-কর্মে পুলিশের মনোবল আরও বৃদ্ধি পাবে, এ জন্য প্রায় এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক লাগবে, এটা আমাদের অনুরোধ। জেলা-উপজেলা ও আদালত ভবনসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করবো। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করবো।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বক্তব্যের আলোকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সড়কে ট্রাফিক ব্যস্থাপনা স্বাভাবিক রাখাসহ পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাজ করছে। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু ইক্যুপমেন্ট সাপোর্ট চেয়েছেন, সেগুলো পুলিশের বিষয়। এর পরেও আপনাদেরকে কিছু ইক্যুপমেন্ট সাপোর্ট দেবো। থানাসহ বিভিন্ন সরকারী স্থাপনার ইক্যুপমেন্টগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে কম্পিউটার, বিদ্যুৎ, লকার, ফাইল কেবিনেট, চেয়ার, টেবিল পূনঃমেরামত করে যত দ্রæত সম্ভব সেগুলো পর্যায়ক্রমে থানাগুলোতে সরবরাহ করে থানাগুলোর কার্যক্রম সক্রিয় করা হবে। থানার গাড়িগুলো পুড়ে গেছে। থানা পুলিশের জন্য নতুন গাড়ি বরাদ্ধ না পাওয়া পর্যন্ত গাড়ি রিক্যুইজিশনের মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রম সক্রিয়করণের জন্য কাজ শুরু করেছি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম স্বাভাবিক ও সমন্বয় করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদেরকে গাড়ি দেয়ে সাপোর্ট দেয়ার আশ্বাস প্রদান করেন ডিসি। একইসাথে সকলের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, চট্টগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। দেশের শতকরা ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানী কার্যক্রম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। এই বন্দরকে সক্রিয় রাখতে কাজ চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। সন্ত্রাসী কার্যক্রম, লুটপাট, নির্যাতন ও চাঁদাবাজ রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করবো। সন্বয়কদের নিরাপত্তায়ও আমরা বদ্ধপরিকর। কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক মোঃ রাসেল আহমেদ বলেন, এ দেশের সর্বস্তরের জনতা ও গণমাধ্যমকর্মীরা আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন বলেই আমাদের আন্দোলন বেগবান হয়েছে এবং আন্দোলনের মুখে ঠিকতে না পেরে স্বৈরাচারী সরকার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সফল হয়েছে। বাংলাদেশে নতুন করে সরকার গঠন না হওয়ায় নতুন করে কিছু জঠিলতা ও অরাজকতা সুষ্টি হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের কিছু দাবী রয়েছে।
দাবীগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে। দাবীগুলো হচ্ছে-শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা। রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নাম পরিবর্তন থেকে বিরত থাকতে হবে। সিন্ডিকেট রোধসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা। আহতদের সুচিকিৎসা ও নিহতদের পরিবারে আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তিগত আক্রোশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ এটির সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্পৃক্ততা নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ জরুরী। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোকে হামলা থেকে রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ট্রাফিক টিম শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তাদেরকে সহযোগিতাকরাসহ নিরাপত্তা দিতে হবে। লেজার লাইট, বড় ছাতা, পানি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে সহযোগিতা দেয়া যেতে পারে। যারা বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা ধবংস করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়কদের মধ্যে বিভিন্ন দাবী দিয়ে বক্তব্য রাখেন পুষ্পিতা নাথ, জোবায়রুল আলম, রিপা মজুমদার, চৌধুরী সিয়াম ইলাহী, নেভী দে, ইশা দে, নীলা আফরোজ, মোঃ ওমর ফারুক সাগর, তানভীর শরীফ, আবদুর রহমান ও আমিনুল হক পিয়াস। সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাহিদুল করিম কচি, মোঃ শাওনেওয়াজ, হাসান ফেরদৌস, সালেহ নোমান, সাইফুল ইসলাম শিল্পী, ডেইজী মওদুদ, আািনুল ইসলাম প্রমূখ।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ সাদিউর রহিম জাদিদ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) একেএম গোলাম মোর্শেদ খান, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিগণ।