১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় রাজনীতিতে এক অনন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ই নভেম্বর হঠাৎ করে আসেনি। এর পিছনে ছিল একটি প্রক্ষাপট, ছিল লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ইতিহাস।
দেশের মুক্তিকামী আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের। কিন্তু স্বাধীনতার কিছু দিনের মধ্যেই জনগণের আকাঙ্ক্ষা ফিকে হতে শুরু করে। ৭২ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে একের পর এক নিয়ম-কানুন জারির মাধ্যমে মানুষের বাক-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা জনগণের মৌলিক অধিকার একেবারে হরণ করে। নির্বাচনে কারচুপি, বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের মূল আকাঙ্ক্ষাসমূহ ধ্বংস, রক্ষীবাহিনীর হত্যা, খুন, আওয়ামীলীগের অত্যাচার, অপশাসন, দূর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় দেশে বিভীষিকাময় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই ৭ই নভেম্বর নিয়ে আলোচনার আগে ৭২-৭৫ পাঠ জরুরি।
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের কারণ গুলো পিছনের ৭২-৭৫ নিপীড়নবাদী শাসনের মধ্যে লুকায়িত। এ সময়কালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। রক্ষীবাহিনী গঠন করে বিরোধী পক্ষের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নির্যাতন, গুম, খুন তথা ৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে চলছিল কার্যত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মহোৎসব।
১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী সমর্থকরা দেশের অর্থ সম্পদ লুটেপুটে খেয়ে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। লাল বাহিনী, নীল বাহিনী, রক্ষীবাহিনী গঠন করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা দেশের হাজার হাজার ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষকে বিনাবিচারে হত্যা করেছিল। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে দেশের লাখ লাখ মানুষকে না খেয়ে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করেছিল। ডাষ্টবিনে মানুষ ও কুকুর খাবার নিয়ে টানাটানি করছে। কাপড়ের অভাবে কলাপাতা দিয়ে লাশ দাফন করতে হয়েছিল। আনজুমান মফিদুল ইসলাম শুধু ঢাকা শহরেই দৈনিক গড়ে ১০ টা বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে।
৭২-৭৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে ১ম ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই, হাইজ্যাক, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, দুঃশাসন, বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্বাচন কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, পরীক্ষায় ফ্রি স্টাইলে নকলের মহোৎসব শুরু হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী উপস্থাপনের ১৫ মিনিটের মধ্যে দেশে প্রচলিত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বাকশাল ব্যবস্থা চালু করেন। এর ফলে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয় এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন, নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ আইন, সরকারি কর্মচারীদের লেখালেখিতে নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার তথা মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছিল। দেশের সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে শুধু সরকারি নিয়ন্ত্রনাধীন ৪টি সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্ক্ষাসমূহ ধ্বংস, রক্ষীবাহিনীর হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার, আওয়ামী লীগের অপশাসন, লুটপাট, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস এবং অরাজক, শ্বাসরুদ্ধকর ও অসহনীয় জঘন্য পরিস্থিতির ফলেই ১৫ই আগষ্ট সংঘটিত হয়েছিল।
সাংবাদিক আহমেদ মুসা লিখিত ""বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সূচনা পর্বঃ ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামীলীগ"" বইটি সে সময়ের অপশাসন, নিপীড়নেরই একটি দলিল।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ দেশের ক্লান্তিলগ্নে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সিপাহী-জনতার মধ্যে তথা সর্বমহলে জিয়াউর রহমান ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। পূর্ববর্তী শাসকের দুঃশাসন, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা এবং ১৫ই আগষ্ট পরবর্তী সেনা অভ্যুত্থান, পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানে বিরাজমান নৈরাজ্য যখন সিপাহী-জনতার মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করছিল তখন জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টমেন্টের বাসায় গৃহবন্দি করাকে সিপাহী-জনতা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিল। বামপন্থী কর্ণেল তাহের এই সুযোগটি গ্রহণ করেন এবং তিন বাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের জিয়াউর রহমানকে বের করে আনতে উদ্ধোত করেন।
কর্ণেল তাহেরের আসল লক্ষ্য ছিল জেনারেল জিয়া নামটি ব্যবহার করে সেনাবাহিনীতে অভ্যুস্থান ঘটানো এবং সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে জিয়াকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু পুরো পরিকল্পনায় জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ও বিচক্ষণতায় সেটা সম্ভব হয়নি। ঘটনাপ্রবাহের শেষ অঙ্কে জেনারেল জিয়াউর রহমান নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৬ই নভেম্বর মধ্যরাতে সিপাহী-জনতার একাত্মতা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেই বিরল দৃশ্য ছিল আবেগ, দেশপ্রেম আর পূর্ববর্তী শাসকদের প্রতি বিষেদগার। চোখে মুখে ছিল একটাই স্বপ্ন একজন জিয়া শক্ত হাতে হাল ধরে বাঁচিয়ে দিবেন দেশকে এবং বন্ধ করবেন রক্তারক্তির রাজনীতি।
৭ই নভেম্বর রাতেই জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেড়িয়ে পরে এবং সারা ঢাকা শহরে সিপাহী বিপ্লব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রাত একটার মধ্যে সিপাহীরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখল নেন এবং ভোরের দিকে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনেন। নৈশ পোশাক পরা অবস্থাতেই উল্লেসিত জওয়ানরা জিয়াউর রহমানকে কাঁধে করে নিয়ে যান ২ ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টারে। সেখানে হাজার হাজার জওয়ানরা জিয়াউর রহমানের সাথে আলিঙ্গন ও করমর্দন করতে থাকেন। জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে সৈনিকদের শান্ত থাকতে বলেন এবং পরে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা বাংলাদেশ বেতারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দেশবাসী অধীর আগ্রহে শোনেন তাদের প্রিয় নেতার কন্ঠস্বর, "আমি মেজর জিয়া বলছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও অন্যান্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িক ভাবে চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনীর প্রধান পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ভাবে নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই।"
রেডিওতে ক্রমাগত সিপাহী জনতার বিপ্লবের ঘোষণা এবং জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখলের খবর শুনে হাজার হাজার লোক স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে আসে। তিন দিন ধরে তারা বিশ্বাস করছিল যে, ভারত খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে তাদের কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন করছে। এখন সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেছে। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ সারারাত স্লোগান দেয়, 'আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ।' আনন্দের এই ঢেউ শহর, নগর ও গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয়—"সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছেন যা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নির্মাণের এক মহারথ। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের ভেদ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন দেশপ্রেমিক সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি’। জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান এবং শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে কাজ করে যাবার আহবান জানান। রাজধানী ঢাকা সেদিন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিলো। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। দেশপ্রেমিক সিপাহী-জনতার মিলন মেলায় ধ্বংস হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সকল ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত সাধারণ মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাংকের সামনে রাখেন ফুলের মালা। এই আনন্দের স্রোত রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে যায়।"
৭ই নভেম্বর সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ""বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড" বইতে লেখেন, '১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। একটি ব্যাপারে ডান ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলই একমত ছিল, আর তা হচ্ছে খালেদ মোশাররফ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে ঘৃণিত বাকশাল ও মুজিববাদ ফিরিয়ে আনতে চাইছে।"
"৭ই নভেম্বরের ভোরের দিকে জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ল। সারা ঢাকা শহরে এই 'সিপাহী বিপ্লব' দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাত ১টার মধ্যেই সিপাহীরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিল। একদল জওয়ান গেল জেনারেল জিয়ার বাসভবনে। চারদিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেলেন জেনারেল জিয়া। নৈশ পোশাক পরা অবস্থাতেই জিয়াকে উল্লসিত জওয়ানরা কাঁধে করে নিয়ে গেল ২ ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টারে। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন বিহ্বল হয়ে পড়েন জিয়া। নাম না জানা অনেক জওয়ানের সঙ্গে আলিঙ্গন, করমর্দন করেন তিনি।"
গ্রন্থটিতে আরও বলা হয়েছে, "রেডিওতে ক্রমাগত সিপাহী জনতার বিপ্লবের ঘোষণা এবং জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখলের খবর শুনে হাজার হাজার লোক স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে এলো। তিন দিন ধরে তারা বিশ্বাস করছিল যে, ভারত খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে তাদের কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন করছে। এখন সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেছে। সর্বত্র জওয়ান এবং সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করল, রাস্তায় নামল। সারারাত তারা স্লোগান দিল, 'আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ।' অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মতো এদেশের মানুষ আবার জেগে উঠেছে। তবে জিয়া মুক্ত হয়ে বরং সৈনিকদের শান্ত থাকতে বলেন। অফিসারদের হত্যা করতে নিষেধ করেন।"
রুশ-ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে রক্ষীবাহিনী গঠন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর উন্নয়নে ক্ষমতাসীনদের অনীহা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, দুঃশাসন এবং ১৫ আগষ্ট পরবর্তী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব ছিল ৭ই নভেম্বর। দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের চেতনা বিরোধী সুগভীর চক্রান্তের বিরুদ্ধে সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফুর্ত বিপ্লব ছিল ৭ই নভেম্বর। মুক্তিকামী জনতার মুক্তির দিন ছিল ৭ই নভেম্বর।
অন্যান্য নেতার চেয়ে জিয়াউর রহমান ছিলেন ব্যতিক্রম। দেশ ও জনগণের স্বার্থে তিনি কখনো আপোস করেননি। সেটি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ কিংবা ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর। দেশের যেকোনো ক্লান্তিলগ্নে তিনি সাহসীকতার সাথে এগিয়ে এসেছেন।
যিনি ৭১ এ জাতির ক্লান্তিলগ্নে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঘোষণায় বিপর্যন্ত দিশেহারা জাতি ভয়ংকর অন্ধকারে আশার আলো দেখেছিল। তেমনি ৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঘোর সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে আবারও ভ্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে নস্যাত হয়ে যায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র। আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ।
জিয়াউর রহমানের কখনো ক্ষমতার লোভ ছিল না। কিন্তু তাঁর এই আপোষহীন নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তায় তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের সফলতার সিঁড়ি বেয়েই আমরা ফিরে পেয়েছি আওয়ামী লীগ কতৃক পদদলিত বহুদলীয় গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ, আইনের শাসন, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ৭ই নভেম্বর সিপাহী- জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতি পেয়েছিল যোগ্য নেতৃত্ব জিয়াউর রহমানকে। সিপাহী-জনতা লোক চিনতে ভুল করেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পরবর্তী জাতি ছিল বহু ভাগে বিভক্ত। জিয়াউর রহমান জানতেন একটি সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ও বর্হি শত্রুর চক্রান্ত মোকাবেলা করতে ঐক্যের কোন বিকল্প নেই।
এ লক্ষ্যে জাতিবাদী বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পরিচয়ের ধারা প্রবর্তন করেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১লা নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রায়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার চেতনা সৃষ্টি করা। জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল দলের মৌল আদর্শ।
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে বাংলাদেশকে "তলাবিহীন ঝুড়ি" বলে আখ্যায়িত করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সে দুর্ভিক্ষের বাংলাদেশকে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে উৎপাদন দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য খাল খনন কর্মসূচি, বীজ অধ্যাদেশ প্রণয়ন, শস্য সংগ্রহ করার যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, যুব সমাজকে নানামুখী ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মমুখী করে তোলা, সার কারখানা স্থাপন, চা বোর্ড গঠন, কৃষি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা, পল্লী বিদ্যুতয়ান বোর্ড গঠন সহ কৃষি ভিত্তিক উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। গ্রামীণ ব্যাংক চালু, ভ্যাট পদ্ধতির উদ্ভাবন সহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। এছাড়াও তিনি তৈরি পোশাক শিল্পের সূচনা, উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিমুখীকরণ, শিল্প বিকাশের জন্য সর্বপ্রথম স্পেশাল বন্ডেড ওয়ারহাউস স্কিম চালু করেন। তাঁর সময়েই অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি ও পোশাক শিল্পের মাধ্যমে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু করে যা এখনও বাংলাদেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের ক্ষুদ্র শাসনামলে তাঁর প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা ভীতের উপর আজও দাঁড়িয়ে আছে দেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও অর্থনীতি। মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, আধুনিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ক্ষণজন্মা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নেতৃত্ব সততা ও আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা নিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছেন মানুষের মনে ।
লেখক-
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
সহ-দপ্তর সম্পাদক
চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দল।
চেয়ারম্যানঃ-আব্দুর রহিম খান,
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো : মাসুদ রানা
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ঢাকার বার্তা ২৪