” বাবা মানে হাজার বিকেল – আমার ছেলে বেলা- বাবা মানে রোজ সকালে – পুতুল পুতুল খেলা ” – জৈনিক গীতিকারের সহস্র আবেগ রসে লেখা এ গানটি আমার অন্যতম একটি প্রিয় গান। এটাকে শুধু গান হিসেবে বোধ করিনা, মনে হয় যেন এতো আমার জীবনের কথা, শৈশবের কথা, অনুভবের কথা। প্রতিটি সন্তানের অনুভূতিতে বাবা শব্দটি হয়তো এমনই। তবে আর দশটা মানুষের তুলনায় নিজেকে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান মনে করি, আমার বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে বাবা ছিলেন মেধায়, কর্তব্য নিষ্ঠায়, সততায়, গরীর- মেধাবী ছাত্রদের জন্য আন্তরিক সহযোগিতায় সত্যি অতুলনীয়, যা বাবার ছাত্রদের মুখে আজো শুনি। ১৯৫১ সালে তৎকালীন ঢাকা বোর্ড (যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রাধীন ছিল) এর অধীনে বাবা কৃতিত্ত্বের সহিত মেট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন। তারপর কলেজে এডমিশন নিলেও পারিবারিক পিছুটান তাঁকে চাকুরির সন্ধানে ছুটতে বাধ্য করেছিলো। বাবার মুখে শোনা – তৎকালীন বিমান বাহিনী ও ফরেস্টে বাবা ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন, এ দু’টো ডিপার্টমেন্টে বাবার চাকুরী হয়েছিলো, কিন্তু ওগুলোতে বাবার যোগদান করা হয়নি। বাবা সর্বপ্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন নরোত্তমপুর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় ( বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) তে, যে বিদ্যালয় থেকে বাবা নিজে মেট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন । আর ওখানকার তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তরনী বাবু বাবার মেধায় মুগ্ধ ছিলেন। কিছু দিন পর ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে বাবা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন সোনাইমুড়ী উত্তর শাহাপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় ( বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) তে। সততা, নিষ্ঠা ও সুনামের সাথে বাবা সেখানে ২/৩ বছরকাল দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ঐ সময়ে বাবার নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে উঠে তখনকার অত্যন্ত খ্যাতনামা পুস্তক প্রকাশনী নোয়াখালী -চৌমুহনীর পুঁথিঘর প্রকাশনীতে। কারণ বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য বাবার লেখা নোট বই, বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই পুঁথিঘর প্রকাশনী হতে প্রকাশিত হয়েছিল, যা তখনকার শিক্ষার্থীদের কাছে নাকি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয়েছিল। এরপর তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন তখনকার সময়ের নোয়াখালীর অন্যতম প্রসিদ্ধ বিদ্যালয় জে, কে, মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় ( বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) তে। ওখানে বাবা সুনাম ও সততার সাথে প্রায় এক যুগের বেশী সময়কাল যাবত শিক্ষকতা করেছিলেন। ঐ সময়ে তিনি পেশাগত সাফল্যের দরুন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। মোটামুটি বেগমগঞ্জে বাবার শিক্ষকতা পেশার প্রায় ১৫ বছরের মতো এক বর্ণিল অধ্যায় কাটে। সেখানে তাঁর জীবনের বহু স্মরণীয় ও মানুষের হৃদয় জয় করার মতো অনেক স্মৃতি গাঁথা রয়েছে। কারন বাবা ওখানে শুধু একজন হেডমাস্টারই ছিলেননা, বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্বও পালন করে সেখাকার মানুষের মনে ঠাঁই নিয়েছিলেন। আজো সেখানকার স্থানীয় প্রবীণরা বাবার ভূয়সী প্রশংসা করে থাকেন। ১৯৬৭ সালে তিঁনি আমাদের নিজ গ্রামের নরোত্তমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমান কবিরহাট উপজেলা, নোয়াখালী) তে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এ বিদ্যালয়ে বাবা অবসরগ্রহণ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। বাবা তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা, সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম উজাড় করে দিয়ে নিজ এলাকার ছাত্র- ছাত্রীদের মানবীয় গুণাবলী ও নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ রুপে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ঐ সময়ে এ বিদ্যালয় হতে প্রায় প্রতি বছরই প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে ছাত্র/ছাত্রী বৃত্তি পেত। বাবা তখন রাজনৈতিকভাবেও ভীষণ সক্রিয় ও সচেতন ছিলেন। তদকালীন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা ছিলেন এবং সেক্ষেও তিঁনি ভীষণ সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসতেন বাবা। রেডিওতে সবসময় খবর শুনতেন। তদকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক এদেশের নিরীহ মানুষের উপর শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবর্দা সোচ্চার ও সজাগ থাকতেন। ১৯৬৮/৬৯ সালের দিগে বাবা সহ আরো কয়েকজন মিলে সর্বপ্রথম আমাদের নরোত্তমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কমিটি গঠন করেন। বাবা ছিলেন উক্ত কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাবা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। সত্যিকারের দেশপ্রেমবোধ থেকে বাবা মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন। বাবার মুখে শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন বাবা আমাদের জেলা শহর মাইজদীতে গেলে কুখ্যাত মতীন রাজাকার বাবাকে আটকে ফেলে এবং নিয়ে যায় পিটিআই রাজাকার ক্যাম্পে। সেখানে বাবার উপর অনেক নির্যাতন করে তারা। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেখান থেকে বাবা প্রাণে বেঁচে মৃত্যুর খুব নিকট থেকে ফিরে আসেন। যার দু-চোখ জুড়ে ছিলো একটি স্বাধীন স্বদেশ, কান পেতে শুনতেন যিনি রেডিওতে স্বাধীনবাংলা বেতার শিল্পিদের উৎবেলিত গান, ভোরের নির্মল বাতাসে খুঁজতেন যিনি লাল- সবুজের পতাকার অমৃত ঘ্রাণ, তাকে থামানোর সাধ্য কার? মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে গেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাবার বিদ্যালয়ে আবার কচিকাঁচাদের ভীড়। বাবা বহু গরীব মেধাবী ছাত্রদের ব্যাক্তিগতভাবে সহায়তার করতেন, বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন, নানানভাবে উৎসাহ দিতেন যাতে গরীর বলে কোন মেধাবী ছাত্রের শিক্ষাকাল অকালে যেন বিনষ্ট না হয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি বাবাকে নিজ এলাকায় সততার সাথে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। বিশেষ করে এলাকার মানুষের জায়গা -জমির হিসাব- নিকাশ, গ্রামীন সামাজিক সালিশ- বৈঠক, মসজিদ কমিটির সভাপতি, সমাজ কমিটির সভাপতি ইত্যাদি কাজে বাবার সততা ও ন্যায়- নিষ্ঠার কারণে এলাকার মানুষ বাবাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যেতে দেখেছি এবং প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে গ্রামের লোকেরা বিভিন্ন বিষয়ে বাবার কাছে আসতেন আমাদের বাড়িতে। বাবার বহু ছাত্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে সচিব পদে, সুপ্রিম কোর্ট এর এডভোকেট, প্রকৌশলী ও সরকারি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে এখোনো কর্মরত আছেন, আবার অনেকেই অবসরও নিয়েছেন।
১৯৯৭ সাল। আমি তখন নোয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্র। তখন একবার ঢাকা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে সকাল ৬ টার উপকূল ট্রেনের টিকিট কাটলাম। যথা সময়ে ট্রেন ছাড়লো নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে। আমার পাশের সিটে একজন ভদ্রলোক বসলেন। কোর্ট- প্যান্ট ও ট্রাই পরা, খুবই গম্ভীর ও স্মার্ট মনে হলো। আমার হাতে ছিলো ” বাংলার বাণী ” নামক তখনকার অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা। গাড় নীচু করে এর সম্পাদকীয় কলাম পড়ছিলাম। পত্রিকা কেনা এবং পড়ার অভ্যাস ছাত্রজীবন থেকেই আমার। কারণ বাবা সব সময় পত্রিকা পড়তেন ও ঘরে আনতেন । ঘন্টাখানেক পর ভদ্রলোক আমার হাতের পত্রিকাটি চাওয়ামাত্র আমি উনার হাতে পত্রিকাটি তুলে দিলাম। আধাঘন্টা অবধি তিনি একনাগাড়ে মনোযোগী রইলেন পত্রিকার পাতায় , পত্রিকায় চোখ রেখেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার বাড়ি কোন জায়গায়? আমি যখন আমার থানা আর গ্রামের নাম বললাম তখন তিনি আমাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন ওখানকার আহমদ উল্যাহ হেড স্যারকে চেন তুমি? বললাম, তিঁনিতো আমার বাবা। লোকটি এবার বললেন, স্যার কেমন আছেন? আমি যখন বললাম, উনি গত বছর (১৯৯৬ খ্রিঃ) এর ১৮ মে ইন্তেকাল করেছেন। তখন লোকটি দাঁড়িয়ে গেলেন, আর অনেক বেশি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, তিনি বাবার স্নেহাশিস একজন ছাত্র ছিলেন, তার নাম আবুল কাশেম, তিনি সোনালি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা, বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সোনাইমুড়ীতে। তিনি আরো বললেন, ছাত্রদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক হিসেবে বাবার আদর্শিক দায়িত্ব, নিষ্ঠা, সহযোগিতা, সততা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কবে অবসরগ্রহণ করেছিলেন? বললাম ১৯৯০ সালে আমাদের নিজ গ্রামের স্কুল নরোত্তমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কবিরহাট, নোয়াখালী থেকে। ট্রেনে যতক্ষণ ছিলেন ভদ্রলোকটির মুখে সারাক্ষণ শুধু আমার বাবার সম্বন্ধে শুনালাম। সোনাইমুড়ী স্টেশনে উনি নামলেন। এভাবে বাবার অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত ছাত্রদের সাথে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ হলে বাবার সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ শুনতে খুব ভালো লাগে। পাশাপাশি এখোনো মনে পড়ে আমি বাবার কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে বাবা আমাকে খুব ভালোসাতেন, অসম্ভব স্নেহ করতেন, তবে আবার দুষ্টুমি করলে বাবার চোখ রাঙ্গানিতে ভীষণ ভয়ে মজে যেতাম৷ সুযোগ হলেই বাবা আমাকে তার সামনে পড়তে বসাতেন। এমন কোন বিষয় ছিলোনা যে, বাবা জানতেননা, বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ, বাংলা সাহিত্য, পাটীগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি এমনকি ভূগোল বিষয়ের অক্ষাংশ – দ্রাঘিমাংশ নিঃখুতভাবে নির্ণয় করণের পদ্ধতি ইত্যাদি বাবা শেখাতেন আমাদের। আরবী ভাষায় ও ছিলো তাঁর অসম্ভব দক্ষতা। ছোট বেলায় আমি যখন ঘরে পবিত্র কুরআন শরীফ পড়তে বসতাম, বাবা তা ক্ষণিক দূর থেকে শুনতেন, আর ভুল হলে তা সংশোধন করে দিতেন। ১৮ মে বাবার ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী গেল। বাবাকে আজ খুব মিস করি। তবে জীবনের প্রতিটি নৈতিক পদক্ষেপে বাবাকে অনুভব করি। কারণ নীতি-নৈতিকতার সংঙ্গাতো বাবাই শিখিয়েছেন। বাবা আজো বেঁচে আছেন এলাকার অগণিত মানুষের মননে এবং চিরদিন বেঁচে থাকবেন তাঁর হাতে গড়া, মানুষের মত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসংথ্য ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ের মনিকোঠায়, ধ্যানে ও সৃজনে। বাবাকে মহান পরওয়ারদিগার জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক – আমিন।
মুহম্মদ শাহাদাত হোসেন (ফিরোজ)
বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক ।