মুহাম্মদ এমরান
বান্দরবান:-লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ২৮৪ নং ইয়াংছা মৌজার ০৯ নং ওয়ার্ডের ঠান্ডাঝীরি স্কুলের পাশেই সড়ক ও উঁচু সুবিশাল পাহাড়। আগে যেখানে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির গাছে পরিপূর্ণ সবুজের সমারহ। কিন্তু এখন পুরো পাহাড়ের অর্ধেকেরও বেশি খাড়াভাবে কেটে সমান করার ফলে তৈরি হয়েছে ‘মরুভূমি’। এভাবেই হরেক রকমের কায়দায় চলছে পাহাড় ধ্বংস। বিগত ৪-৫ মাস প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর এই ভয়াবহ আগ্রাসন চললেও নেই কারও মাথাব্যাথা। পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামায় এভাবে আইনের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে পাহাড় কাটা চলছে।
ফাঁসিয়াখালীর ০৯ নম্বর ওয়ার্ড ঠান্ডাঝীরি নামক এলাকায় গত ৪-৫ মাস ধরে রাতের আঁধারে পাহাড় কেটে তৈরি করেছে বাড়ি। খাড়াভাবে পাহাড় কাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা ঠান্ডাঝীরি বনপুর সড়কের ঠান্ডাঝিরী নামক এলাকায় বিশালাকৃতির পাহাড় কেটে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে একটি পাহাড় খেকো পরিবার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রিকসলিন রাস্তার পাশের বড় একটি উঁচু পাহাড় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল বা খাড়াভাবে অর্ধেকের বেশি অংশ কাটা শেষ হয়েছে। পুরো পাহাড়ের গায়ে রয়েছে একাধিক যন্ত্রের দিয়ে কাটার চিহ্ন। রাস্তার পাশের এই পাহাড়টির পেছনের দিকের আরও কয়েকটি পাহাড়ও কাটা চলছে। পাহাড় কাটার পর পরিত্যক্ত মাটি গুলো দিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে ফসলি জমি ও চলাচলের রাস্তা। পাহাড় কেটে ধ্বংসের মুখের রয়েছে হাজারো মানুষের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েই প্রতিদিন হাজার কয়েক গাড়ি চলাচল করে। গাড়ি চলাচলকারী এই পথ ধরে সামনে এগুতেই চোখের সামনে পড়ল ভয়াবহ দৃশ্য! প্রথম দিকের উঁচু পাহাড় সামনে বিশালাকৃতির পাহাড়টি কেটে সমান করা হয়েছে। এবং রাস্তার উপরেই চলে আসছে।
তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে পাহাড় খেকো মাহামদউল্লাহ'কে পাওয়া যায়নি, কিন্তু তার স্ত্রী'কে পাওয়া গেছে। তার স্ত্রীর কাছ থেকে তার মোবাইল নাম্বার নিয়ে মোবাইলে তার সাথে যোগাযোগ করলে পাহাড় কাঁটার কথা স্বীকার করে সাংবাদিককে বলেন, আমি একটি বাড়ি ও টিউবওয়েল বসানোর জন্য পাহাড়টি কেটেছি।
পুরো ধবংসযজ্ঞ স্থানের আয়তন প্রায় ০১ একর হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। যার মালিক রোহিঙ্গা মাহামদউল্লাহ। তবে পাহাড় কাটার সঙ্গে আরও বেশকয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানা গেলেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সমতল করা জায়গার উপর নির্মাণ করা হয়েছে একটি বাড়ি, পাহাড়ের গর্ভে বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে রয়েছে। সরজমিনে দেখা গেছে, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বাড়ির উপরে একাধিক পাহাড়ের স্থান ভেঙ্গে পড়েছে। এ বিষয়ে মাহামদউল্লাহ'কে বললে সে বলেন, আমাদের জীবনের মায়া আমাদের রয়েছে। আমি সবকিছু চিন্তা করেই এইখানে বাড়ি নির্মাণ করেছি।
আবার ব্রিকসলিন রাস্তাটির পশ্চিম দিকে আরেকটি পাহাড় কেটে সমতল করা হচ্ছে। এতে করে পাহাড়টির উপর দিয়ে তৈরি রাস্তাটি'ও ঝুঁকিতে পড়েছে।
পাহাড় কাটার বিষয়ে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলেও তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। স্থানীয়রা এভাবে পাহাড় কাটার পক্ষে না থাকলেও প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা কারও নেই।নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ঠান্ডাঝিরী এলাকার এক বাসিন্দা জানান, ৪-৫ মাস ধরে রাতের আঁধারে পাহাড়টি খাড়াভাবে কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পাহাড় কাটায় অভিযুক্ত মাহামদউল্লাহ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পার্বত্য বান্দরবানের এলাকাগুলোতে সবখানেই উঁচু-নিচু পাহাড়। সামান্য বৃষ্টি হলেই পাহাড় কাটতে হয়। নিজের জায়গা, সেজন্য অনুমতির বিষয়টি দেখা হয়নি। আর প্রশাসন থেকেও আমাদের কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। পতিত পাহাড়টি মূলত কেটে সমান করেছি একটা বাড়ি নির্মাণ করার জন্য। বাড়ি নির্মাণের পরে আবার একটি টিউবওয়েল বসানোর জন্য আবারো পাহাড় কাটাতে হয়ছে। আমি বাড়িতে ছিলাম না, মানুষ দিয়ে পাহাড় কেটেছি। আমি বাড়িতে না থাকা অবস্থায় ওরা পাহাড় কেটে রাস্তার পাশে চলে গেছে। পরবর্তীতে আমি এসে তা দেখতে পাই, এবং তাদের গালি দিয়ে পাহাড় কাটা বন্ধ করেছি।
সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, পাহাড় একটি দেশের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাহাড় বনজ সম্পদ, জীবপ্রজাতি এবং খনিজ ও কৃষিজ পণ্যের উৎস। পার্বত্য বান্দরবানের বেশির ভাগ পাহাড়ের অনেক গভীর পর্যন্ত বালির আধিক্য রয়েছে। ফলে পাহাড় কাটলে ভূমিধসের বড় ঝুঁকি তৈরি হয়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় কাটা নিত্য ঘটনায় রূপ নিয়েছে। অবাধে পাহাড় কাটার কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে পরিবেশ। বিশেষ প্রয়োজনে পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতির বিধান থাকলেও কেউ অনুমতির তোয়াক্কা করছেন না। রাজনৈতিক ও বিভিন্ন চাপের কারণে দেখা যায় স্থানীয় প্রশাসনও পাহাড় কাটারোধে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদারকি না বাড়াতে পারলে ভূ-প্রকৃতি আরো ঝুঁকিতে পড়বে।
এছাড়া পাহাড় কাটা বন্ধে স্থানীয়রা সচেতন না হলে কেবল সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এটা রোধ করা কঠিন।পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ৬(খ) অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটায় স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই আইনে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদফতরের ছাড়পত্র গ্রহণ করে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যেতে পারে। পরিবেশ আইনের ধারা ১৫ এর দণ্ডবিধানে বলা আছে, পাহাড় বা টিলা কাটার প্রমাণ পাওয়া গেলে অনধিক এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার দণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
স্হানীয় ইউপি সদস্য আপ্রুসিং মার্মা বলেন, পাহাড় কাঁটার বিষয়টি জেনে আমি তাকে কয়েকবার নিষেধ করেছি। কিন্তু সে আমার কথা অমান্য করে রাতের আঁধারে বারবার পাহাড় কেটে রাস্তার পাশে চলে আসছে। এতে মানুষের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
চেয়ারম্যানঃ-আব্দুর রহিম খান,
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো : মাসুদ রানা
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ঢাকার বার্তা ২৪